সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৫:৪০ পূর্বাহ্ন
সুমন হোসাইন:দেশের অপার সম্ভাবনাময় সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে কাংঙ্খিত উন্নয়ন না হওয়ায় বৃহৎ উন্নয়নের স্বার্থে “বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ” করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। শুক্রবার (২৮জুন) বিকালে নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মোস্তফা কামাল বেনাপোল বন্দরের নবনির্মিত কার্গো ভেহিকেল টার্মিনাল পরিদর্শনে আসলেও স্থলবন্দর ব্যবহারকারী কোন সংগঠনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেননি। ২০০২ সালে বেনাপোল স্থলবন্দর ঘোষনা করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে যায় এই বন্দর। কিন্তু দীর্ঘবছর ধরে অবকাঠামোগত উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। সক্ষমতা বাড়াতে বন্দরে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা বারবার তাগিদ দিলেও দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন হয়নি এই বন্দরে। ফলে ব্যবসায়ীরা বন্দরে উন্নয়নের জন্য বেনাপোল স্থলবন্দরের অব্যবস্থাপনা,দুর্নীতি,পণ্যজট,অনিয়মের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সুষ্ঠ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে “বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ” গঠন করলে সঠিক ব্যবস্থাপনা সহ বাণিজ্য উন্নয়ন সাধিত হবে বলে মনে করছেন। বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা জানান,গত ২০ বছর ধরে বেনাপোল বন্দরে পণ্যর ধারনক্ষমতা মাত্র ৪০ হাজার টন সেখানে আমদানিকৃত পণ্য থাকে ৩ থেকে ৪ লাখ টন। বিশাল এই পণ্য খালাশ করে রাখতে নতুন করে আরও ৩০ টি শেডের প্রয়োজন ব্যবসায়ীদের কিন্তু গত ২০ বছরেও নতুন করে কোন শেড নির্মান করেনি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ পুরাতন কয়েকটি শেড সংস্কার ছাড়া। ফলে নানা সংকটে চরম ভোগান্তির শিকার দু’দেশের আমদানি-রফতানিকারকরা। সম্ভাবনাময় বিশাল চাহিদা সম্পূর্ন বন্দর দীর্ঘদিনেও যুগোপযোগী উন্নয়ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়। বেনাপোল বন্দর থেকে ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক শহর কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি দুই দেশের ব্যবসায়ীদের। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে বেনাপোল বন্দরে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। বন্দরে জায়গার অভাবে দিনের পর দিন পণ্য নিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। যার প্রভাব পড়ছে দেশীয় বাজারে আমদানি পণ্যের ওপর। অথচ এ বন্দর থেকে প্রতিবছর সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে।
ভারতীয় বিধান সভার সদস্য শ্রী অশোক কীর্তানিয়া গত ১০ই জুন তার ইস্যুকৃত চিঠিতে জানান, বেনাপোল বন্দরের পণ্য খালাসসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান চেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন বন্দরে অনলোড থেকে শুরু করে লরি ভারতে ঢোকা পর্যন্ত স্থলবন্দরের ১৪টি পয়েন্ট যেমন কারপাশ,ওয়েট স্কেল,ষ্টোর কিপার,আনছার,ষ্টোর টেন্ডেল, প্রবেশ ও এক্সিট টোংঘর,নাইটগার্ড়,চালান সই,বর্ডারম্যান সহ অদৃশ্য রিসিটে ট্রাকপ্রতি খরচ ৪হাজার থেকে ৫হাজারে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও বন্দরে গাড়ী প্রবেশের পর যায়গার অভাবে দীর্ঘদিন সময় ক্ষেপনে ট্রাকপ্রতি বড় অংকের টাকা ক্ষতিপূরন গুনতে হচ্ছে। ট্রাক হতে ব্যটারী ও পণ্য চুরি,জায়গা সংকট বন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানিয়েও কোন সমাধান পাননি। মুঠোফোনে দৈনিক মাতৃছায়াকে তিনি জানান,ভারত হতে যখন বেনাপোল বন্দরে লরি প্রবেশ করবে সে লরি সম্পূর্ন দ্বায়িত্ব পড়ে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কিন্ত বাংলাদেশে সম্পূর্ন ভিন্ন। বন্দরে লরিতে থাকা পণ্য ও চালকের সাথে বিভিন্ন অপৃতিকর ঘটনা ঘটলে অভিযোগ দিলেও কোন সূরহা মেলেনা।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান একসাথে নতুন করে দেশের ১৫ থেকে ২০টি বন্দরে উন্নয়ন কাজ করছেন। অথচ অপার সম্ভাবনাময় সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে দীর্ঘ ২২ ধরে কাংঙ্খিক উন্নয়ন হয়নি। এজন্য দেশের বাণিজ্যে সক্ষমতা বাড়াতে বেনাপোল বন্দরকে আলাদা করে চট্রগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মতো বেনাপোল স্থলবন্দকে “বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ” গঠন করে পরিচালনার দাবি জানাচ্ছি।
বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দীন গাজী বলেন, সুষ্ঠু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেনাপোল বন্দরে সমস্যার শেষ নেই। বন্দরের জায়গার অভাবে সময়মতো পণ্য লোড ও আনলোড করা যাচ্ছে না। এছাড়া বন্দরে ২২ বছরে দৃশ্যমান উন্নয়ন না হওয়ার কারনে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা। বন্দরে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্টান গুলোর চরম দুর্নীতি ও অনিয়মের বিভিন্ন অভিযোগ বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোন প্রতিকার মিলছেনা। অথচ এ বন্দর থেকে সরকার প্রতিবছর ৮হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশন সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, বেনাপোল বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে বন্দর কর্তৃপক্ষকে বলা হলেও কার্যত কোন ভূমিকা নেই। ফলে লোকসান ভোগ করতে হচ্ছে বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের। বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশের ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ীর বাণিজ্যের চাহিদা থাকলেও যথাযথ উন্নয়ন নেই বন্দর কর্তৃপক্ষের। পাশ্ববর্তী ভরতের পেট্রাপোল বন্দরকে ২০০৮ সালে স্থলবন্দর ঘোষণার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে সেখানে আগামী ২০০ বছরের পরিকল্পনা করে আধুনিক মানের অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে। সেখানে আমাদের বন্দর দুইশত বছর পিছিয়ে রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতামত ও গুরুত্ববুঝে বন্দর আধুনিকায়ন করা জরুরী। দেশের চট্রগ্রাম,মোংলা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ গঠন করে যেমন উন্নয়ন হয়েছে তেমনি “বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ” গঠন করলে বন্দরের সকল সমস্যা দ্রূত সমাধান হবে। ফলে দেশের বাণিজ্যে সম্প্রসারন ব্যপকহারে বৃদ্ধি সহ বন্দর থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে।
বেনাপোল কাস্টমস্ হাউসের ডেপুটি কমিশনার অথেলো চৌধুরী বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দরে আধুনিক মানের অবকাঠামো তৈরী হলে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। বর্তমান বন্দরের অনিয়মের বিষয়ে বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনের পক্ষ থেকে কমিশনার বরাবর কয়েকটি চিঠি এসেছে। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করবো।
এ বিষয়ে বেনাপোল বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, গত ১৫ বছরে বন্দর আধুনিকায়নে সরকারি ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৬৮৫ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে। ২৪ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন ভেহিকল ট্রাক টার্মিনালের কাজ চলমান রয়েছে। তাছাড়া পণ্যাগার বাড়ানো, চুরি রোধে সিসি ক্যামেরা ও বন্দরের চারপাশে প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ করার কোন পরিকল্পনা আছে কি জানতে চাইলে তিনি বলেন এটা মন্ত্রাণালয়ের ব্যাপার।