বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩১ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক
তাবলীগ জামাতের কাকরাইলের বহুতল মসজিদ নির্মাণের নামে কয়েক’শ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির একাংশের আমীর সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ভবনটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের দীর্ঘ ৯ বছর পার হলেও রাজধানীর কাকরাইলে মারকাজ মসজিদ নির্মাণ হয়নি আজও। অভিযোগ উঠেছে এই ভবন নির্মানের জন্য দেশি-বিদেশি ডোনারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আয় হলেও তা এককভাবে আত্মসাৎ করেছে তাবলীগ জামায়াতের বর্তমান একাংশের শুরা-ফয়সাল (আমীর) সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম।
তাবলীগ জামায়াতের এই ১২ তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মানের জন্য ২০১০ সালের শুরুর দিকে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর থেকেই দেশি বিদেশি নানা ডোনারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এই ভবন নির্মাণের বিপুল পরিমান অর্থ। কিন্তু সেই অর্থ সংগ্রহ করে জমা রাখা হয় সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের এইচএসবিসি ও সিটি ব্যাংকের ব্যাক্তিগত হিসাবে।
বিষয়টি নিয়ে সেই সময় শুরু হয় তাবলীগ জামায়াতে শুরা সদস্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিতর্ক। এ বিতর্ক শুধুমাত্র দেশের মধ্যে সিমাবদ্ধ থাকনি। দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিদেশেও উঠে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড়। এ ঘটনায় তাবলীগ জামায়াতের তৎকালীন প্রবীণ মুরুব্বি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুশফিক আহমেদ ভবন নির্মাণের টাকা একক একাউন্টে থাকবে, নাকি যৌথ একাউন্ট করা হবে সে বিষয়ে মাশয়ারায় (পরামর্শসভায়) আনার দাবী তোলে। কিন্তু ওয়াসিফুল ইসলাম তা না করে উল্টো এই দাবি তোলার অপরাধে অধ্যাপক মুশফিকের অনুসারীদের কোনঠাসাঁ করে ফেলে। এমনকি অধ্যাপক মুশফিকের অনুসারিরা কোন মসজিদে জামায়াত নিয়ে গেলে তাদের মারপিট করে বের করে দেওয়া হতো।
ওয়াসিফ ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ওঠে ২০১২ সালে টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে ৯৪ কোটি টাকার সরকারি অনুদান গ্রহণকে কেন্দ্র করে। এরপর কাকরাইলের মসজিদ নির্মাণের নামে সংগৃহীত প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তাবলীগ জামাতের ভেতরেই।
২০১৩ সালে ইজতেমা প্রাঙ্গণে সৈয়দ ওয়াসিফের কামরা থেকে বিশাল অংকের টাকা পাওয়ার ঘটনাকে মেনে নিতে পারেননি তাবলীগের সেই সময়ের কর্মীরা। এসব অর্থসম্পৃক্ত বিষয়গুলোতে তার কাছে অসংখ্যবার ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও তিনি পাত্তা দেননি বলে অভিযোগ করেছিলেন প্রয়াত তাবলীগের তৎকালীন প্রবীণ দায়িত্বশীল অধ্যাপক মুশফিক আহমেদ। এ বিষয়ে তৎকালীন সময়ে বেশকিছু গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক মারা যান ২০১৫ সালের শেষের দিকে।
অর্থ বিষয়ে সৈয়দ ওয়াসিফের অস্পষ্ট ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলায় ২০১৬ সালে তাবলীগের বেশকিছু সদস্যকে মারধর করার অভিযোগ করেছেন মাওলানা আশরাফ আলী ও মেহেদি হাসান। এই দুজন তাবলিগি সাথী রমনা ও টঙ্গী থানায় ওয়াসিফুলের নামে পৃথক মামলাও করেছিলেন।
তৎকালীন সময়ে মাওলানা আশরাফ আলীকে টঙ্গী ময়দানে জঙ্গি বলে ও কাকরাইলে মেহেদি হাসানকে মারধরে করে ওয়াসিফের অনুসারীরা। এ কারণে রমনা থানায় সৈয়দ ওয়াসিফ ও তার ছেলে ওসামার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে মেহেদি হাসান নামে ঐ তাবলীগ কর্মী। এ মামলায় আসামি হিসেবে মাহফুজুল হান্নান নামে একজন প্রকৌশলীর নামও রয়েছে। যিনি সৈয়দ ওয়াসিফের খুব কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
অভিযোগ আছে সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম সর্বপ্রথম ১৯৮৪ সালে অবৈধভাবে ধানমন্ডির নিজ বাসায় মহিলা মারকাজ স্থাপনের মাধ্যমে। মহিলারদের এ মারকাজ স্থাপনের পর মহিলা কর্মীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা হাদিয়া। যে টাকার হিসেব আজও দিতে পারেনি ওয়াসিফুল ইসলাম।
এরপর ২০০৪ সালে ওয়াসিফুল ইসলামের স্ত্রী মিনু (মিনু আপা নামে পরিচিত) মাস্তুরাত শাখার নিয়ন্ত্রণ পেয়ে তাদের বাসায় মহিলা মাকরাজ আবারো চালু করে। আর এই মাকরাজ থেকে হাদিয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
বিশ্বের প্রায় ২৮১টিরও বেশি দেশের নাগরিকের অংশগ্রহণে এ তাবলিগ জামাত নানা প্রশ্নের সম্মুখী হয়েছে শুধুমাত্র এই ওয়াসিফুল ইসলামের কারণেই বলে তাবলীগ জামাতের কর্মীদের কাছে এখন প্রকাশ্য বিষয়।
তাবলিগ জামাত অরাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হলেও সম্প্রতি ওয়াসিফুল ইসলামের নেতৃত্বে এ চক্রটি তা রাজনৈতিকভাবে পরিচালনার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। তাবলিগের নামে অর্থ আদায়, রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তাবলিগ জামাতের সংশ্লিষ্টতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছবি ব্যঙ্গ করার অভিযোগও রয়েছে। এসব কর্মকান্ড বন্ধ করতে মুসল্লিরা মাঠে নেমেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় মাওলানা সা’দকে বাংলাদেশে আসার বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপে মারামারি ঘটনাও ঘটে। গেল বছরের শেষের দিকে একজন তাবলীগ কর্মী মারা যান, আহত হোন অনেকে। ওয়াসিফুল ইসলামের এসব কর্মকান্ড যারাই বন্ধ করতে চান তারাই নানাভাবে বিপদের সম্মুখীন হোন।
তাবলীগ কর্মীদের অভিযোগ, ওয়াসিফুল ইসলাম ও তার ছেলে ওসামা ইসলাম তাবলিগ জামাতের নামে কোটি কোটি টাকা বিদেশিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়ে তা নিজের অ্যাকাউন্টে রেখে ব্যবসার কাজে ও জমি ক্রয়সহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের পেছনে ব্যয় করছেন। তাদের উইং কমান্ডার হিসেবে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান ও মাওলানা আবদুল মতিন। অভিযোগ উঠেছে ওয়াসিফুল ইসলাম বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলিগ জামাতের নামে অর্থ এনে তা আত্মসাত্ করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় সফরের নামে অর্থ এনে ওই টাকা আত্মসাত করেন ওয়াসিফুল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাবলীগের এক সাথী দৈনিক মাতৃছায়াকে বলেন, ওয়াসিফুল ইসলাম ও তার বাহিনীর সদস্যরা অনেকটা বেপরোয়া। তারা এমন জঘন্যতম কাজ করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। তাবলিগ জামাতের নাম ভাঙিয়ে শত শত কোটি টাকা অর্থ আত্মসাত্ করেছেন। ইতোপূর্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে তার জঙ্গি কানেকশনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। তার সঙ্গে জিহাদি ব্লগারদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাতৃছায়ার পক্ষ থেকে সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার মোবাইল ফোনটি তার এক সহযোগির হাতে দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। পরে তার সহযোগির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি নামাজের পর কথা বলবেন বলে জানায়। কিন্তু আজও তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি।