সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৯:০৮ অপরাহ্ন
রঞ্জু রানা-
অনেকদিন ধরে ভাবছি একটা কলাম লিখব কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না।
আমরা যাদেরকে ভালোবাসি তাদের সামনেই কথাগুলো তুলে ধরতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু কি করব আমি যে দাঁড়িয়ে আছি মহাসমুদ্রের দ্বারপ্রান্তে যেখানে আমি বাঁচতে চেষ্টা করছি সামান্য খরকুটোর উপর নির্ভর করে, হয়তো অতিরিক্ত কষ্ট থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রবাসীদের এই নীরবতা।
২০০৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় পাড়ি জমাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র স্বপ্নের সিটি সিঙ্গাপুরে।
এখানে প্রবেশের অনুমতি পায় একজন দালান নির্মাণ কর্মী হিসেবে। যাইহোক প্রবাস জীবনের ১৩ বছর শেষ করে ১৪ বছরে পা দিলাম ।সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। সেই সাথে সকল প্রবাসী জন্য দোয়া করবেন , সকল প্রবাসী যেন ভালো থাকে।
প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে একজন প্রবাসীকে মুখোমুখি হতে হয় নানাবিধ সমস্যার আমরা আমাদের মাতৃভূমিতে বড় হয়েছি, আমাদের আছে নিজস্ব ভাষা কালচার সংস্কৃতি এবং নিজেদের খাদ্যাভ্যাস। কিন্তু প্রবাসে এসে আমরা হয়ে উঠি সদ্য জন্ম নেওয়া নতুন শিশুর মত এখানে আমাদের সাজাতে হয় আবার নতুন করে জীবন। প্রবাসে এসে পারি না প্রাণ খুলে কথা বলতে , পারিনা নিজের ভেতরের অনুভূতিটাকে প্রাণখুলে কারো সাথে শেয়ার করতে। থাকি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কেননা এদেশের সাথে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মিল থাকেনা।
মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাবার অন্যতম। আমরা সাধারণত দেশ ত্যাগ করার আগে মায়ের হাতে স্ত্রী কিংবা বোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তৈরিকৃত খাবার খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে থাকি। কিন্তু প্রবাসে এসে তাদের হাতে রান্নার ছিটেফোটাও খুঁজে পাওয়া যায় না । যে খাদ্য হাতের কাছে পাই আমাদের গলা দিয়ে নামতে অনেক কষ্ট হয় । পারিনা পেট ভরে খেতে। তারপরও একমুঠ খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি কারন আমরা তো প্রবাসী। পারিনা পরিবারের মানুষের সঙ্গে এই বিষয়গুলো শেয়ার করতে কারণ একজন প্রবাসী জানে পরিবারের কত বড় দায়িত্ব নিয়ে দেশের মায়া ত্যাগ করে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে। কিছু সময় নিজের দুঃখ-কষ্ট চেয়ে দায়িত্ব নামক মহান শব্দটি আমাদেরকে নিরব করে রাখে।
প্রত্যেকটা জাতির কাছে নিজস্ব সংস্কৃতি খুব প্রিয়। প্রবাসে এসে নিজের সংস্কৃতিকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আপনারা সকলেই জানেন একটা সুস্থ মানুষের মনকে সুস্থ রাখতে হলে সংস্কৃতির অবদান উল্লেখযোগ্য এখানে আমি একটি উদাহরণ বলতে চাই ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস যখন এ রকমের সাংস্কৃতিক দিনগুলি আমাদের সামনে আসে শত ব্যস্ততা থাকার পরেও মনটা চায় উল্লাসে মেতে উঠতে দেশ ও দেশের মাটিতে এইসব মুহূর্তগুলো সাক্ষী হয়ে থাকতে। মন পরে পহেলা বৈশাখের জন্য যখন দেশের মানুষ উল্লাসে মেতে ওঠে তখন আমরা দায়িত্বের দাবানলে চাপা খেয়ে শরীরের ঘাম ঝরাতে থাকি তাইতো আমরা প্রবাসী। মনটা কেঁদে ওঠে দেশীয় সংস্কৃতি গুলো উদযাপনের সময়।
আসুন কাজের জায়গায় কি হয় সেটা আপনাদের সামনে তুলে ধরি প্রত্যেকটা মানুষ এই প্রবাসে আসার আগে হয়তো দেশে টুকিটাকি কাজ করেছেন কিন্তু নিদৃষ্ট সময় নিয়ে কাজ করার অভ্যাস ছিল বলে আমার মনে হয় না।
প্রথমের দিকে এই বিষয়টি প্রত্যেকটা প্রবাসীর কাছে বিষের মত মনে হয় বিশেষ করে আমি যেহেতু সিঙ্গাপুরে থাকে সিঙ্গাপুরে সকাল ৮ থেকে বিকেল ৫ পর্যন্ত মৌলিক ডিউটি।
কোম্পানির যদি কাজ থাকে আবার অতিরিক্ত কিছু ঘন্টা ডিউটি পালন করতে হয়। এখন বলেন আমরাও তো মানুষ যান্ত্রিক রোবট নয়।সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হতে হয় কাজে যাওয়ার জন্য এবং অধিকাংশ মানুষ রুমে ফিরে রাত ৯ টার পর। এখন আপনারাই ভেবে দেখেন আমরা কতটা সময় ব্যস্ত থাকি ।
কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে এসে নিজের ঘর গুছানো জামা কাপড় পরিষ্কার করা নিজের আনুষাঙ্গিক কাজ সারতে সারতে হয়ে ওঠে মধ্যরাত।
আবার ঘুম , ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই সকাল আবার ডিউটি ।
ভাগ্য পরিবর্তনের দৌড় ঝাপ দিতে গিয়ে কতবার মৃত্যুবরন করে প্রবাসীরা তার খবর কে রাখে?
আসুন দেখি আমাদেরকে নিয়ে দেশের মানুষের ভাবনা-
দেশের মানুষ ও পরিবার-পরিজনের ধারণা রূপকথার কাহিনীর মত আমি যখন দেশে ছিলাম আমার ধারণা রূপকথার কাহিনীর মতোই ছিল
“” প্রবাসী বলতে একটা সুখি মানুষকে ইঙ্গিত করা হয় যাদের কোনো অভাব নেই , পকেট ভর্তি টাকা ও মন এবং দেহের সুখের ফুলঝুরি ও ফুলের বিছানায় বসবাস সবকিছু যেন আমাদের হাতের নাগালে ইচ্ছে হলেই উপভোগ করতে
পারি ।”””
জানি আমার কথা গুলো বিশ্বাস করতে শুভাকাঙ্খীদের খুব কষ্ট হবে কারণ মনে রাখবেন স্বপ্নের রং এবং বাস্তব জীবনের রং কখনো এক হয়না তা মিলাতে গেলে তিলকে তাল বানানো সমান পরিশ্রম করতে হয়।
দেশে বসবাসরত আমাদের শুভাকাঙ্খীদের আমাদের সম্পর্কে ধারনা তারা মনে করে আমরা স্বার্থপর, আমরা নাকি নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে স্বার্থপর হয় তাহলে প্রত্যেকটা মুহূর্তে কেন দেশের জন্য কাঁদি কেন প্রিয়জনদের জন্য কাঁদি কেন বলি মহান আল্লাহতায়ালা আমার মৃত্যু দিলে তুমি আমায় দেশের মাটিতেই দিও।
প্রত্যেকটা প্রবাসীর আপনজনদেরকে বলতে চাই প্রবাসীদের মনে কষ্ট দিবেন না তারা শুধু একটু ভালবাসার কাঙ্গাল ভালোবাসা পেলে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতে তারা প্রস্তুত। সকল প্রবাসী যদি স্বার্থপর হত তাহলে এই সোনার বাংলায় তার রূপ পরিবর্তন করতে পারত না। প্রবাসীদের এই রেমিটেন্সের টাকার কারণে সোনার বাংলা আজকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরে রেমিটেন্স উপার্জন করতে গিয়ে আমাদের শরীরের রক্ত ঘাম হয়ে ঝরে পড়ে,
তারপরেও যখন আপনারা বলেন আমরা স্বার্থপর সহ্য করার ক্ষমতা প্রবাসীদের থাকেনা তারা শুধু নীরবে কাঁদে। প্রবাসীরা পারে না বলতে পারিনা সইতে।
একটা জ্বলন্ত মোমবাতির মত নিজে জ্বলে পুরা দেশ জাতি এবং পরিবারকে আলোকিত করে রাখার চেষ্টা করে। আমরা খোঁজখবর নিতে না পারলে কখনই ভাববেন না আপনাদেরকে ভুলে গিয়েছি। আপনাদেরকে আমরা হৃদয়ের মনিকোঠায় সব সময় ধারণ ও বহন করে রাখি। হয়তো সময়ের অভাবে আপনাদের খোঁজ নিতে পারি না।
আমাদের ও ইচ্ছা হয় দেশ এ গিয়ে দেশের মাটিতে পরিবার পরিজনের সাথে মুক্তবাতাস ও মুক্ত সংস্কৃতিতে নিজের মায়ের কোলে মাথা রেখে বুক ভরে নিশ্বাস নেই। কিন্তু আমরা ভুল করেছি স্বার্থপরের মত এই সুখ ভোগ না করে প্রবাসে এসেছি।
প্রবাসীদের জন্য দোয়া করবেন সকল প্রবাসীরা যেন তার মায়ের কোলে সুস্থভাবে ফিরে যেতে পারে।
ভালো থাকুক সকল প্রবাসী এ প্রত্যাশা করি মহান আল্লাহ রাব্বুল
আল আমিনের কাছে।
লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর বোবা কান্না ও হৃদয়ের কিছু কথা তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র।