দুই দেশই পরস্পরের জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করার পাল্টাপাল্টি দাবি করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আলোচনায় বসার আহ্বান জানালেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নীরবতা বাড়িয়ে তুলেছে টেনশন।
পাকিস্তান দাবি করেছে, বুধবার সকালে কাশ্মীরে তাদের নিয়ন্ত্রিত অংশে ভারতীয় দুটো মিগ-২১ জঙ্গি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে তারা। আটক করা হয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক বৈমানিককে।
অন্যদিকে ভারতের দাবি, তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করা একটি পাকিস্তানি এফ-১৬ জেট ফাইটারকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। পাকিস্তানি বিমানটি পড়েছে কাশ্মীরের পাকিস্তানি অংশে। ওই আকাশযুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি মিগ-২১ এবং পাইলট নিখোঁজ হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান তাদের পুরো আকাশসীমায় বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতও তাদের উত্তরাংশের নয়টি বিমানবন্দর বন্ধ রেখেছে। ফলে আন্তর্জাতিক রুটের বাণিজ্যিক ও যাত্রীবাহী বিমানগুলোকে বড় একটি এলাকা এড়িয়ে চলতে হচ্ছে।
কাশ্মীরকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসা ভারত ও পাকিস্তান ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলটির দুটি অংশ শাসন করে আসছে। মাঝের কাল্পনিক সীমারেখার নাম তারা দিয়েছে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’।১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মোট চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে বৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ, তার মধ্যে তিনবারই তাদের লড়াই হয়েছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে।
তবে ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম দুই দেশ আকাশ যুদ্ধে জড়ালো বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় দুই সপ্তাহ আগে আত্মঘাতী হামলায় দেশটির সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) ৪০ জনের বেশি জওয়ান নিহত হওয়ার পর দুই দেশের উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়।
এরপর মঙ্গলবার ভোররাতে ভারতের বিমান বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে পাকিস্তানের বালাকোটে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করলে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়।
এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর অন্তত ৫০টি স্থানে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের দিকে মর্টার শেল ছোড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারপর মঙ্গলবার সকালে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজৌরি জেলায় নওশেরা সেক্টরে বোমাবর্ষণ করলে আকাশে শুরু হয় লড়াই।
Information Ministry
✔@MoIB_Official
Wreckges of Indian fighter planes burning. Well done Pakistan Air Force. The entire nation is proud of you.
রয়টার্স জানিয়েছে, বালাকোটে ভারতের বিমান হামলার পর গত দুদিন ধরে কাশ্মীর সীমান্তের ডজনখানেক এলাকায় মর্টার দিয়ে পাল্টা পাল্টি গোলাবর্ষণ করেছে দুই দেশ।
তবে এই উত্তেজেনার মধ্যে বুধবার সকাল থেকে ঠিক কী ঘটেছে তা নিয়ে দুই দেশই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে।
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর বলেছেন, ভারতের বিমান হামলার জবাবে তাদের বিমানবাহিনী সকালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অভিযানে যায়। ছয়টি নির্দিষ্ট স্থাপনা লক্ষ্য করে ওই অভিযান শুরু হলেও সেখানে হামলা না চালিয়ে তারা খোলা জায়গায় বোমা বর্ষণ করে ফিরে এসেছে।
আসিফ গফুরের দাবি, প্রাণহানি যাতে না হয় সেজন্যই পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালায়নি।
“উত্তেজনা বাড়ুক- তা আমরা চাই না। তবে বাধ্য করা হলে নিজেদের ভূখণ্ডে আত্মরক্ষার সক্ষমতা ও পূর্ণ প্রস্তুতি যে পাকিস্তানের আছে, সেটার প্রমাণ দিতেই এ অভিযান চালানো হয়েছে।”
পাকিস্তানি এই সেনা কর্মকর্তার দাবি, তাদের অভিযানের জবাব দিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর দুটি জঙ্গি বিমান পাকিস্তানি আকাশসীমায় প্রবেশ করলে সেগুলো গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ফাইটার পড়েছে কাশ্মীরের ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশে, অন্যটি পাকিস্তানের অংশে বিধ্বস্ত হয়েছে। ওই বিমানের একজন পাইলটও পাকিস্তানের হাতে ধরা পড়েছে।
পাকিস্তানের তথ্য মস্ত্রণালয় সকালে একটি ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে চোখ বাঁধা অবস্থায় রক্তাক্ত এক বৈমানিককে দেখিয়ে বলা হয়- তিনি ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান। পরে আরেকটি ভিডিওতে তাকে চায়ের কাপ হাতে কথা বলতেও দেখা যায়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাভিশ কুমার এক সংবাদ সম্মেলনে আকাশযুদ্ধের ভিন্ন একটি বিবরণ দেন। তার দাবি, ভারতীয় সামরিক স্থাপনায় পাকিস্তানি বিমান হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ভারত একটি পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে, তবে সেটা পড়েছে কাশ্মীরের পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত অংশে। আর প্রতিরোধে অংশ নেওয়া ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি জঙ্গি বিমান ও পাইলট নিখোঁজ রয়েছে।
PIB India
✔@PIB_India
#Pakistan Air Force targeted #Indian military installations this morning; IAF detected and foiled the attempt; #IAF shot down 1 Pakistani aircraft; Unfortunately we lost 1 MiG 21 aircraft: @MEAIndia
পরে দিল্লিতে পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার সৈয়দ হায়দার শাহকে তলব করে একটি প্রতিবাদলিপি ধরিয়ে দেওয়া হয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয় সেখানে।
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, ভারতীয় বিমান বাহিনীর একজন আহত ব্যক্তিকে ভিডিওতে ‘অশোভনভাবে’ উপস্থাপন করে পাকিস্তান ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন’ করেছে।
ইমরানের হুঁশিয়ারি, আলোচনার ডাক
কাশ্মীরের আকাশে লড়াইয়ের পর টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে আসেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সেখানে ভারতীয় প্রতিপক্ষের উদ্দেশে আলোচনার আহ্বান জানান তিনি।
ইমরান বলেন, যা চলছে তা এভাবে চলতে দিলে পরিস্থিতি তার বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
“আজকের অভিযানের মধ্য দিয়ে আমরা শুধু এটাই দেখাতে চেয়েছি যে, তারা যেভাবে আমাদের এলাকায় অনুপ্রবেশ করে হামলা চালিয়েছি, আমরাও তাদের এলাকায় ঢুকে তা করে দেখাতে পারি।”
বুধবারের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া এখনও আসেনি। তবে তিনি একটি অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে করেছেন বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
আর ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ চীন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, ভারত ‘দায়িত্বশীলতা’ আচরণই করে যাবে। উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই।
ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে এই সংঘাত জটিল এক পরিস্থিতির সামনে ফেলেছে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদীকে।
সংযমের আহ্বানবিশ্লেষকরা বলছেন,পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার জবাবে পাকিস্তানের ভেতরে জঙ্গি আস্তানায় আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেওয়ায় রাজনৈতিকভাবে মোদীর জনপ্রিয়তা বাড়ার সুযোগ ছিল।
কিন্তু ভারতের বিরোধীদলগুলো অভিযোগ করেছে, মোদী সংঘাতকে পুঁজি করে ভোটে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন।
পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং আনের সাথে আলাপ করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন ভিয়েতনামে রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। দুই পক্ষকেই তিনি ধৈর্য্য ধারণ করার এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি এড়ানের পরামর্শ দিয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পাকিস্তানের বড় মিত্র দেশ চীনও সবপক্ষ সংযমের পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড পার্লামেন্টে বলেন, “আমি দুই দেশের হাই কমিশনারের সঙ্গেই কথা বলব। তাদের আরও সংযমের পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানাব।”